অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সংসদীয় আসনে চারটি আঞ্চলিক সড়ক চওড়া করতে ১ হাজার ২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি এমন সময়ে নেওয়া হলো যখন সরকার অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ব্যয় কমাতে মনোযোগী।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ২০২৩ সালের শেষ অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে রাস্তা চওড়া করার এই প্রকল্প ভোটের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে সুবিধা দেবে। যদিও চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে মানুষ যখন কষ্টে, তখন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেই ভর্তুকি কমানোর চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে রেকর্ড হারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের পাইকারি দর বাড়ানোর পর খুচরায় মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় গত ২২ নভেম্বর রাস্তা চওড়া করার প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, সভায় অন্তত তিন সচিব বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার বিপক্ষে মত দেন। আবার অনেকে পক্ষেও ছিলেন। পরে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়।
এ বিষয়ে নানাভাবে চেষ্টা করেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পটি সবে অনুমোদন দিয়েছি। এখনই সব টাকা ছাড় করা হবে না। আগামী চার বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পের সঙ্গে ডলারের কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থনৈতিক সংকট চললেও আমরা সব ধরনের কাজ বন্ধ করিনি।’
অবশ্য এর আগে গত ১৭ মে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকটে সরকারও কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর একটি হলো, উন্নয়ন প্রকল্পকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া। শুধু জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেই এখন পূর্ণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর নতুন প্রকল্প অনুমোদন এখন একেবারেই কম। নতুন প্রকল্প গ্রহণে নিরুৎসাহিতও করা হচ্ছে। কিছু প্রকল্প ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
অর্থসংকটের কারণে বয়স্ক ব্যক্তি এবং বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীত নারীদের নতুন করে ভাতার জন্য তালিকাভুক্তিও বন্ধ রয়েছে।
চার রাস্তা চওড়া হবে
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, লালমাই ও নাঙ্গলকোট—এই তিন উপজেলা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। উপজেলাগুলোতে চারটি রাস্তা চওড়া করা হবে। এক. সুয়াগঞ্জ-পিপুলিয়া সড়ক। সড়কটির দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার। চওড়া গড়ে সাড়ে চার মিটার, যা বাড়িয়ে সাড়ে পাঁচ মিটার করা হবে। দুই. বাংগড্ডা-মাহিনীবাজার-ঢালুয়া বাজার-বিরুলী-বক্সগঞ্জ সড়ক। এটির দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটার। রাস্তাটি গড়ে ৪ দশমিক ৭৮ মিটার চওড়া, যা সাড়ে পাঁচ মিটারে উন্নীত করা হবে। তিন. কুমিল্লা বালুতুপাড়-কনেশতলা-সুয়াগাজী-বিজয়পুর-আদিনামুড়া-আমড়াতলী সড়ক। এটি সাড়ে ৫ মিটার চওড়া করা হবে, যা এখন রয়েছে ৩ দশমিক ৯৪ মিটার। এ রাস্তার দৈর্ঘ্য ৩৫ কিলোমিটার। চার. কুমিল্লা সদর দক্ষিণ-হাজতখোলা-কলমিয়া-শানীচৌ-নুরপুর-লালমাই সড়ক। এটির দৈর্ঘ্য ২৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ৩ দশমিক ১৬ মিটার। রাস্তাটিকে সাড়ে পাঁচ মিটার চওড়া করার কথা বলা হয়েছে প্রকল্পে।
সব মিলিয়ে ৮৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রাস্তা প্রশস্ত করা হবে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) বলা হয়েছে, রাস্তাগুলো প্রশস্ত করতে ২১০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে মানুষের বাড়িঘর ও কৃষিজমি রয়েছে। প্রকল্প ব্যয়ের ৭০০ কোটি টাকা খরচ হবে জমি অধিগ্রহণে।
প্রকল্পটি নিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। অধিদপ্তরের কুমিল্লা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, যেসব জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, তার মধ্যে কৃষিজমি খুবই কম। মূলত রাস্তার দুই পাশে মানুষের বাড়িঘর ও দোকান রয়েছে। তবে কতটুকু কৃষিজমি অধিগ্রহণ করতে হবে, সেটি তিনি বলতে পারেননি।
বিপক্ষে মত যাঁদের
একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য গত ২২ নভেম্বর উত্থাপনের পর যে তিন সচিব বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সদ্য বিদায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সূত্র বলছে, বিপক্ষে মত দেওয়া সচিবদের যুক্তি ছিল—চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে। এই মুহূর্তে রাস্তা প্রশস্ত করা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার সড়কগুলো জাতীয় মহাসড়ক নয়, নতুন রাস্তাও নয়। সেগুলো উপজেলা সড়ক।
রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে ২১০ একর জমি অধিগ্রহণ করা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, এখন রাস্তা প্রশস্ত না করে সংস্কার করা যেতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাওয়ার পর এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া যায়।
অবশ্য একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের পক্ষে মত দেন এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ, সড়ক ও পরিবহন সচিব আমিন উল্লাহ নুরীসহ অন্যরা। সব পক্ষের মতামত নেওয়া শেষে প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন পায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সচিব প্রথম আলোকে বলেন, বিপক্ষে যাঁরা মত দিয়েছিলেন, তাঁদের যুক্তি আমলে নেওয়া হয়নি।
রাস্তা চওড়া করার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পুরো অর্থই ব্যয় করবে সরকার। ২০২৬ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিপিপিতে বলা হয়েছে, এটি সেবামূলক একটি প্রকল্প। যেসব সড়ক ও সেতু নির্মিত হবে, সেগুলোতে যান চলাচলে কোনো টোল নেওয়া হবে না। ফলে এই প্রকল্প থেকে আর্থিক লাভ পাওয়া যাবে না। কিন্তু ব্যবহারকারীরা সুফল পাবেন।
জানতে চাইলে দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এখন কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে। সেটি প্রতিদিন জনগণকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন সময়ে রাস্তা চওড়া করতে অর্থমন্ত্রীর এলাকায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য নেওয়া হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এমন একটি প্রকল্প নেওয়া সরকারের নিজস্ব নীতিমালারই লঙ্ঘন।