০৭:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শত শত নিউজও কোনো পরিবর্তন আসলো না

দক্ষিণাঞ্চলের অদেখা হাহাকার গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল ভব

নাঙ্গলকোটের গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ১৫ বছরেও এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যসেবায় আলো ছড়াতে পারেনি। দীর্ঘদিন থেকে পরিত্যাক্ত থাকায় হাসপাতালটির মুল ভবন এবং আবাসিক ভবনের দরজা নেই, জানালার গ্লাস ভাঙ্গাচুরা রয়েছে। সর্বত্র ময়লা-আর্বজনা জমে আছে। আবাসিক ভবনে মাদক সেবীদের আড্ডাখানা। হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঝোঁপ-জঙ্গল, সবজির বাগান এবং একজন বাকপ্রতিবন্ধী, ছাগলসহ আবাসন গড়েছেন। হাসপাতালের সামনে দু‘টি নিছু জমি বেদখল হয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। সীমানা প্রাচীর না থাকায় হাসপাতালটি অরক্ষিত এবং উত্তর পাশের মাটি ভেঙ্গে একটি দিঘীতে হাসপতালটি বিলীন হচ্ছে। বর্তমানে হাসপাতালটির মুল ভবন এবং আবাসিক ভবনের দরজা নেই। জানালার গ্লাস ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বাথরুমগুলোর বেসিন ও কমেড ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন রুমগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। এছাড়া, হাসপাতালের লাইট, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, আলমিরা, চেয়ার, টেবিলসহ সব চুরি হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে যায়, ২০০৩ সালে জোড্ডা ইউনিযনের গোহারুয়া গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান আমিন ভূঁইয়া ও তার ভাইয়েরা হাসপাতালের জন্য তিন একর জমি দান করেন। ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়া নাঙ্গলকোটের প্রত্যন্ত এলাকা জোড্ডা ইউনিয়নের গোহারুয়া, নিশ্চিন্তপুর, মান্দ্রা, মানিকমুড়া, দামুরপাড়, পাশ্ববর্তী মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া, বিনয়ঘর, ভোগই ও নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার বিরাহিমপুর গ্রামের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক তৃণমূল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গোহারুয়া ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
পরে জোট সরকারের শেষ দিকে ২০০৬ সালের ১৭ অক্টোবর তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী আমান উল্ল্যা হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। আবাসিক ভবন নির্মাণসহ আন্তঃবিভাগ ও বহিঃবিভাগের সুবিধা নিয়ে হাসপাতালটি চালু করা হয়। কিন্তু উদ্বোধনের কিছুদিন হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৪ সালের শেষ দিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দাবির মুখে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সার্বিক সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতিতে ওই সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ কে এম নাসিম এমপি হাসপাতালটিতে শুধুমাত্র বহিঃবিভাগে স্বাস্থ্যসেবা চালু করেন।
কিন্তু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ না করে , মূল ভবনসহ আবাসিক ভবন সংস্কার না করে, বহিঃবিভাগ চালু থাকলেও কোন ওষুধ বরাদ্ধ না থাকা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকায় আন্তঃবিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালু করা সম্ভব না হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম আবার স্থবির হয়ে পড়ে।
জানা যায়, হাসপাতালটিতে যাতায়াত ব্যবস্থা অনুন্নত, সীমানা প্রাচীর না থাকা, বিলের মধ্যে হাসপাতালটি স্থাপন, ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী, ল্যাব, পরিচ্ছনাকর্মী না থাকায় হাসপাতালটিতে রোগী আসতে চান না। প্রতিদিন বহিঃবিভাগে ৪/৫ জন রোগী আসেন। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে জুনিয়র কনসালেন্ট (গাইনী) মাতুয়ারা শারমীন দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া, মেডেকেল অফিসার আয়েশা আক্তার শেফাকে এখানে পদায়ন করা হলেও তার পরিবর্তে তার স্বামী ডাঃ মাহবুব হাসান নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন। সিনিয়র ব্রাদার আজিজুর রহমান ও টিকেট কাউন্টার লিপি আক্তারকে এখানে পদায়ন হলেও তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করেন। একমাত্র ওয়ার্ড বয় রাকিবুল হাসান হাসপাতালটি দেখভাল করছেন।
গত ১০ডিসেম্বর হাসপাতালটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, হাসাপাতালটির মূল ভবনের বিভিন্ন কক্ষের দরজা নেই। জানালার গ্লাস ভাঙ্গাচুরা, বাথরুমের বেসিন এবং কমেড ভেঙ্গে পড়ে আছে। পরিত্যক্ত কক্ষগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। দ্বিতীয়তলার কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকায় ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালের আবাসিক ভবনগুলো সম্পূর্ণ ব্যবহারের অযোগ্য অবস্থায় রয়েছে।
দ্বিত্বল বিশিষ্ট পরিত্যাক্ত একটি আবাসিক ভবনের দরজা-জানালা নেই। জনালার কাচগুলো ভাঙ্গা রয়েছে। থাকার রুম এবং বাথরুমগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সর্বত্র ময়লা-অবর্জনা জমে আছে। বাথরুমের কমেড ভেঙ্গে-চুরে পড়ে আছে। বিভিন্নরুমে ও ছাদে সিগারেটের টুকরা, প্লেয়িং কার্ডের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আবাসিক ভবনটি মাদক ও জুয়াখোরদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। ছাদে এলাকার কিশোরদের টিক-টক ভিডিও তৈরী করতে দেখা যায়।
অন্য একটি আবাসিক ভবনে গত প্রায় দেড় বছর থেকে দরিদ্র বাকপ্রতিবন্ধী আবুল কাশেম আবাসন গড়েছেন। তিনি বিভিন্ন সবজির বাগান, পেঁপে ও নারকেল গাছ রোপণ করেছেন। তিনি আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছাগল পালনসহ নিজে বসবাস করেন। সে পাশ্ববর্তী বিভিন্ন বাজারে ঝাঁড়ুদারের কাজ করে হাসপাতালের আবাসিক ভবনে এসে রাত্রিযাপন করেন। আবাসিক ভবনের ভাঙ্গা দরজা বাহিরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। একটি বৈদ্যুতিক খামও ভেঙ্গে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
গোহারুয়া গ্রামের দরিদ্র বয়োবৃদ্ধ রুহুল আমিন (৭২) হাসপাতালের উত্তর-পশ্চিম পাশে সবজির বাগান করেছেন। তিনি লাউ, বেগুন, মরিচ এবং পেঁপে গাছ লাগিয়েছেন। রুহুল আমিনকে দুর থেকে পানি নিয়ে সবজি গাছে দিতে দেখা যায়। তিনি বলেন, জায়গা খালি পড়ে থাকায় ঝোঁপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে জায়গাটি তৈরী করে সবজির বাগান করেছি। এতে নিজের খাওয়া চলে এবং বাজারে সবজি বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করছেন।
হাসপাতালের উত্তর পাশে সীমানা প্রাচীর না থাকায় প্রায় ৭ ফুট অংশ মাছ চাষের একটি দিঘীতে (বড় পুকুর) বিলীন হয়ে গেছে। ধীরে-ধীরে দিঘীটি হাসপাতালের দিকে ভেঙ্গে যাওয়ায় যে কোন মুহুর্তে হাসপাতালের ভবন দিঘীতে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
হাসপাতালাতে ঢুকতে দু‘পাশের নিচু জমিতে গোহারুয়া গ্রামের জিয়াউল হক খান ও নুরুল হক দখলে নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে মাছ চাষ করছেন। জানা যায়, তারা প্রতিবছর ৩০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাছ চাষির নিকট জমিগুলো বন্ধক দিয়েছেন।
তারা এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চান না।
হাসপাতালে আগত গোহারুয়া গ্রামের শেপালী বেগম জানান, ওয়ার্ড বয় রাকিবুল হাসানের কাছে ডাক্তার আসার খবর পেয়ে তার প্রসূতি পুত্রবধু তানজিলাকে গাইনী বিশেষজ্ঞ মাতুয়ারা শারমীনকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। একই গ্রামের ইয়াছিন (৪৫) জানান, তার মেয়ে সুরাইয়ার (২০মাস) সর্দি, কাশি হওয়ায় মেডিকেল অফিসার ডাঃ মাহবুব হাসানকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। এছাড়া একই গ্রামের উম্মে হানি (৩২) তার ছেলে আহম্মদ উল্ল্যাকে ( ২) জ¦র ও কাশি নিয়ে ডাঃ মাহবুব হাসানকে দেখাতে আসেন। কিন্তু ডাক্তার না আসায় দু‘জন তাদের মেয়ে এবং ছেলেকে ডাক্তার না দেখিয়ে ফিরে যান।
ওয়ার্ড বয় রাকিবুল হাসান জানান, ২০০৭ সালে হাসপাতালটি বন্ধ হওয়ার পর ২০১৪ সালের অক্টোবরের মাসে হাসপাতালের জনম তালা খোলা হয়। এর আগে চোরের দল হাসপাতালের লাইট, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, আলমিরা, চেয়ার, টেবিল ও দরজা-জানালাসহ সব চুরি করে নিয়ে যায়।
ঐতিহ্য টিভির পরিচালক ও দৈনিক বাংলাদেশ কন্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক গোহারুয়া গ্রামের সমাজকর্মী এনাম ভূঁইয়া বলেন, হাসপাতালটিতে উদ্বোধনের কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। নাঙ্গলকোটের কৃতি সন্তান বাংলাদেশ প্রতিদিন এর সম্পাদক নঈম নিজামের মাধ্যমে তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডি জি দ্বীনমোহাম্মদ হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন। পরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ কে এম নাসিম এমপি, অর্থমমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপিসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা চালু করা হয়। বর্তমানে ২/১জন ডাক্তার বহিঃবিভাগে রোগী দেখেন। হাসপাতালের সীমান প্রাচীর না থাকায় মাদকসেবী ও জুয়াখোরদের আড্ডা খানায় পরিণত হয়েছে। আবাসিক ভবনগুলো পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। আবাসিক ভবনে যেখানে ডাক্তার ও নার্স থাকার কথা রয়েছে। সেখানে গরু, ছাগল বসবাস করছে। হাসপাতালটি একটি ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। এলাকার কিশোর ছেলেরা হাসপাতালটিকে শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকট দাবি জানান, হাসপাতালটিতে ডাক্তার, নার্স নিয়োগ প্রদান, আবাসিক ভবনগুলো সংস্কার,সীমান প্রাচীর নির্মাণ এবং নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দিয়ে এলাকার অবহেলিত তৃণমূল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর দাবি জানান।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ দেব দাস দেব জানান, বর্তমানে হাসপাতালটিতে বহিঃবিভাগ চালু থাকলেও কোন ওষুধ বরাদ্ধ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকায় আন্তঃবিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালু সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালটির প্রধান সমস্যা হচ্ছে সীমানা প্রাচীর নেই। হাসপাতালটি একটি বিলের মধ্যে এবং দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। ওই এলাকাটি আন্তঃজেলা ডাকাত দলের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। নিরাপত্তা প্রহরী না থাকায় হাসপাতাল এলাকাটিতে নিরাপত্তার সংকট রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মচারীরা এখানে থাকতে চান না। হাসপাতালটির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ এবং আবাসিক ভবন সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে।
তিনি আরো বলেন, হাসপাতালটির সীমানা প্রচীর নির্মাণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে। হাসপাতালটিতে ঢুকতে দু‘পাশে^র জমি অবৈধ দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, জমিগুলো আমাদের কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। হাসাপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সেবা চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখকের পরিচিতি

শত শত নিউজও কোনো পরিবর্তন আসলো না

দক্ষিণাঞ্চলের অদেখা হাহাকার গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল

আপডেট সময় : ১২:৪৯:২০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ মে ২০২৩
নাঙ্গলকোটের গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ১৫ বছরেও এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যসেবায় আলো ছড়াতে পারেনি। দীর্ঘদিন থেকে পরিত্যাক্ত থাকায় হাসপাতালটির মুল ভবন এবং আবাসিক ভবনের দরজা নেই, জানালার গ্লাস ভাঙ্গাচুরা রয়েছে। সর্বত্র ময়লা-আর্বজনা জমে আছে। আবাসিক ভবনে মাদক সেবীদের আড্ডাখানা। হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঝোঁপ-জঙ্গল, সবজির বাগান এবং একজন বাকপ্রতিবন্ধী, ছাগলসহ আবাসন গড়েছেন। হাসপাতালের সামনে দু‘টি নিছু জমি বেদখল হয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। সীমানা প্রাচীর না থাকায় হাসপাতালটি অরক্ষিত এবং উত্তর পাশের মাটি ভেঙ্গে একটি দিঘীতে হাসপতালটি বিলীন হচ্ছে। বর্তমানে হাসপাতালটির মুল ভবন এবং আবাসিক ভবনের দরজা নেই। জানালার গ্লাস ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বাথরুমগুলোর বেসিন ও কমেড ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন রুমগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। এছাড়া, হাসপাতালের লাইট, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, আলমিরা, চেয়ার, টেবিলসহ সব চুরি হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে যায়, ২০০৩ সালে জোড্ডা ইউনিযনের গোহারুয়া গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান আমিন ভূঁইয়া ও তার ভাইয়েরা হাসপাতালের জন্য তিন একর জমি দান করেন। ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়া নাঙ্গলকোটের প্রত্যন্ত এলাকা জোড্ডা ইউনিয়নের গোহারুয়া, নিশ্চিন্তপুর, মান্দ্রা, মানিকমুড়া, দামুরপাড়, পাশ্ববর্তী মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া, বিনয়ঘর, ভোগই ও নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার বিরাহিমপুর গ্রামের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক তৃণমূল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গোহারুয়া ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
পরে জোট সরকারের শেষ দিকে ২০০৬ সালের ১৭ অক্টোবর তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী আমান উল্ল্যা হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। আবাসিক ভবন নির্মাণসহ আন্তঃবিভাগ ও বহিঃবিভাগের সুবিধা নিয়ে হাসপাতালটি চালু করা হয়। কিন্তু উদ্বোধনের কিছুদিন হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৪ সালের শেষ দিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দাবির মুখে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সার্বিক সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতিতে ওই সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ কে এম নাসিম এমপি হাসপাতালটিতে শুধুমাত্র বহিঃবিভাগে স্বাস্থ্যসেবা চালু করেন।
কিন্তু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ না করে , মূল ভবনসহ আবাসিক ভবন সংস্কার না করে, বহিঃবিভাগ চালু থাকলেও কোন ওষুধ বরাদ্ধ না থাকা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকায় আন্তঃবিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালু করা সম্ভব না হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম আবার স্থবির হয়ে পড়ে।
জানা যায়, হাসপাতালটিতে যাতায়াত ব্যবস্থা অনুন্নত, সীমানা প্রাচীর না থাকা, বিলের মধ্যে হাসপাতালটি স্থাপন, ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী, ল্যাব, পরিচ্ছনাকর্মী না থাকায় হাসপাতালটিতে রোগী আসতে চান না। প্রতিদিন বহিঃবিভাগে ৪/৫ জন রোগী আসেন। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে জুনিয়র কনসালেন্ট (গাইনী) মাতুয়ারা শারমীন দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া, মেডেকেল অফিসার আয়েশা আক্তার শেফাকে এখানে পদায়ন করা হলেও তার পরিবর্তে তার স্বামী ডাঃ মাহবুব হাসান নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন। সিনিয়র ব্রাদার আজিজুর রহমান ও টিকেট কাউন্টার লিপি আক্তারকে এখানে পদায়ন হলেও তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করেন। একমাত্র ওয়ার্ড বয় রাকিবুল হাসান হাসপাতালটি দেখভাল করছেন।
গত ১০ডিসেম্বর হাসপাতালটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, হাসাপাতালটির মূল ভবনের বিভিন্ন কক্ষের দরজা নেই। জানালার গ্লাস ভাঙ্গাচুরা, বাথরুমের বেসিন এবং কমেড ভেঙ্গে পড়ে আছে। পরিত্যক্ত কক্ষগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। দ্বিতীয়তলার কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকায় ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালের আবাসিক ভবনগুলো সম্পূর্ণ ব্যবহারের অযোগ্য অবস্থায় রয়েছে।
দ্বিত্বল বিশিষ্ট পরিত্যাক্ত একটি আবাসিক ভবনের দরজা-জানালা নেই। জনালার কাচগুলো ভাঙ্গা রয়েছে। থাকার রুম এবং বাথরুমগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সর্বত্র ময়লা-অবর্জনা জমে আছে। বাথরুমের কমেড ভেঙ্গে-চুরে পড়ে আছে। বিভিন্নরুমে ও ছাদে সিগারেটের টুকরা, প্লেয়িং কার্ডের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আবাসিক ভবনটি মাদক ও জুয়াখোরদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। ছাদে এলাকার কিশোরদের টিক-টক ভিডিও তৈরী করতে দেখা যায়।
অন্য একটি আবাসিক ভবনে গত প্রায় দেড় বছর থেকে দরিদ্র বাকপ্রতিবন্ধী আবুল কাশেম আবাসন গড়েছেন। তিনি বিভিন্ন সবজির বাগান, পেঁপে ও নারকেল গাছ রোপণ করেছেন। তিনি আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছাগল পালনসহ নিজে বসবাস করেন। সে পাশ্ববর্তী বিভিন্ন বাজারে ঝাঁড়ুদারের কাজ করে হাসপাতালের আবাসিক ভবনে এসে রাত্রিযাপন করেন। আবাসিক ভবনের ভাঙ্গা দরজা বাহিরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। একটি বৈদ্যুতিক খামও ভেঙ্গে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
গোহারুয়া গ্রামের দরিদ্র বয়োবৃদ্ধ রুহুল আমিন (৭২) হাসপাতালের উত্তর-পশ্চিম পাশে সবজির বাগান করেছেন। তিনি লাউ, বেগুন, মরিচ এবং পেঁপে গাছ লাগিয়েছেন। রুহুল আমিনকে দুর থেকে পানি নিয়ে সবজি গাছে দিতে দেখা যায়। তিনি বলেন, জায়গা খালি পড়ে থাকায় ঝোঁপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে জায়গাটি তৈরী করে সবজির বাগান করেছি। এতে নিজের খাওয়া চলে এবং বাজারে সবজি বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করছেন।
হাসপাতালের উত্তর পাশে সীমানা প্রাচীর না থাকায় প্রায় ৭ ফুট অংশ মাছ চাষের একটি দিঘীতে (বড় পুকুর) বিলীন হয়ে গেছে। ধীরে-ধীরে দিঘীটি হাসপাতালের দিকে ভেঙ্গে যাওয়ায় যে কোন মুহুর্তে হাসপাতালের ভবন দিঘীতে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
হাসপাতালাতে ঢুকতে দু‘পাশের নিচু জমিতে গোহারুয়া গ্রামের জিয়াউল হক খান ও নুরুল হক দখলে নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে মাছ চাষ করছেন। জানা যায়, তারা প্রতিবছর ৩০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাছ চাষির নিকট জমিগুলো বন্ধক দিয়েছেন।
তারা এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চান না।
হাসপাতালে আগত গোহারুয়া গ্রামের শেপালী বেগম জানান, ওয়ার্ড বয় রাকিবুল হাসানের কাছে ডাক্তার আসার খবর পেয়ে তার প্রসূতি পুত্রবধু তানজিলাকে গাইনী বিশেষজ্ঞ মাতুয়ারা শারমীনকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। একই গ্রামের ইয়াছিন (৪৫) জানান, তার মেয়ে সুরাইয়ার (২০মাস) সর্দি, কাশি হওয়ায় মেডিকেল অফিসার ডাঃ মাহবুব হাসানকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। এছাড়া একই গ্রামের উম্মে হানি (৩২) তার ছেলে আহম্মদ উল্ল্যাকে ( ২) জ¦র ও কাশি নিয়ে ডাঃ মাহবুব হাসানকে দেখাতে আসেন। কিন্তু ডাক্তার না আসায় দু‘জন তাদের মেয়ে এবং ছেলেকে ডাক্তার না দেখিয়ে ফিরে যান।
ওয়ার্ড বয় রাকিবুল হাসান জানান, ২০০৭ সালে হাসপাতালটি বন্ধ হওয়ার পর ২০১৪ সালের অক্টোবরের মাসে হাসপাতালের জনম তালা খোলা হয়। এর আগে চোরের দল হাসপাতালের লাইট, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, আলমিরা, চেয়ার, টেবিল ও দরজা-জানালাসহ সব চুরি করে নিয়ে যায়।
ঐতিহ্য টিভির পরিচালক ও দৈনিক বাংলাদেশ কন্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক গোহারুয়া গ্রামের সমাজকর্মী এনাম ভূঁইয়া বলেন, হাসপাতালটিতে উদ্বোধনের কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। নাঙ্গলকোটের কৃতি সন্তান বাংলাদেশ প্রতিদিন এর সম্পাদক নঈম নিজামের মাধ্যমে তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডি জি দ্বীনমোহাম্মদ হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন। পরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ কে এম নাসিম এমপি, অর্থমমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপিসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা চালু করা হয়। বর্তমানে ২/১জন ডাক্তার বহিঃবিভাগে রোগী দেখেন। হাসপাতালের সীমান প্রাচীর না থাকায় মাদকসেবী ও জুয়াখোরদের আড্ডা খানায় পরিণত হয়েছে। আবাসিক ভবনগুলো পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। আবাসিক ভবনে যেখানে ডাক্তার ও নার্স থাকার কথা রয়েছে। সেখানে গরু, ছাগল বসবাস করছে। হাসপাতালটি একটি ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। এলাকার কিশোর ছেলেরা হাসপাতালটিকে শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকট দাবি জানান, হাসপাতালটিতে ডাক্তার, নার্স নিয়োগ প্রদান, আবাসিক ভবনগুলো সংস্কার,সীমান প্রাচীর নির্মাণ এবং নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দিয়ে এলাকার অবহেলিত তৃণমূল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর দাবি জানান।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ দেব দাস দেব জানান, বর্তমানে হাসপাতালটিতে বহিঃবিভাগ চালু থাকলেও কোন ওষুধ বরাদ্ধ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকায় আন্তঃবিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালু সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালটির প্রধান সমস্যা হচ্ছে সীমানা প্রাচীর নেই। হাসপাতালটি একটি বিলের মধ্যে এবং দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। ওই এলাকাটি আন্তঃজেলা ডাকাত দলের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। নিরাপত্তা প্রহরী না থাকায় হাসপাতাল এলাকাটিতে নিরাপত্তার সংকট রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মচারীরা এখানে থাকতে চান না। হাসপাতালটির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ এবং আবাসিক ভবন সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে।
তিনি আরো বলেন, হাসপাতালটির সীমানা প্রচীর নির্মাণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে। হাসপাতালটিতে ঢুকতে দু‘পাশে^র জমি অবৈধ দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, জমিগুলো আমাদের কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। হাসাপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সেবা চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।