বাস্তব কিছু কারনে চরমোনাই পীর বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিন দিন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি তাদের মেয়ের ‘ওয়ালিমা’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিত হওয়া রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতার বড় উদাহরণ। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে দলটির এই ওয়ালিমার রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন রকম চর্চা অব্যাহত রয়েছে। চরমোনাই পীর আলোচনায় আসার আরেকটি বড় কারণ, বরিশাল সিটি নির্বাচনে স্বয়ং দলের নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিমের মেয়র পদে প্রার্থীতা ঘোষণা।
বিয়ের পর ছেলের পক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী ও গরিব-মিসকিনদের তৌফিক অনুযায়ী আপ্যায়ন করাকে ‘ওয়ালিমা’ বলে। বাংলায় ওয়ালিমাকে বউভাত বলা যেতে পারে। বিয়ের পরদিন বা পরবর্তী সময়ে সুবিধামতো নিকটতম সময়ের মধ্যে ওয়ালিমা করা বিধেয়। তবে তিন দিনের মধ্যে করা উত্তম। এক দিন ওয়ালিমা করা সুন্নত, দুই দিন ওয়ালিমা করা মুস্তাহাব, তিন দিন ওয়ালিমা করা জায়েজ। কিন্তু চরমোনাই পীরের ওয়ালিমার ব্যাপারে কিছু সমালোচনা তৈরি হয়েছে৷ ছেলে নয়, মেয়ের বিয়ে দিয়েই কেন পীর সাহেবরা ওয়ালিমা করলেন এটা নিয়ে হচ্ছে এক রকমের সমালোচনা, আরেক সমালোচনা হচ্ছে বিয়ের বেশ কয়েকমাস যাওয়ার পর কেন এই আয়োজন? আমি এসব ‘হালকা’ সমালোচনার বিশ্লেষণে না গিয়ে বরং এর রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলাপ করতে চাই৷
চরমোনাই পীরদের আমরা এখনও পীর হিসেবেই ট্রিট করি। তাদের যে একটি রাজনৈতিক দল আছে এবং এরা যে রাজনীতিবিদ আমরা প্রায়ই এই কথা ভুলে যাই। যেহেতু তারা রাজনৈতিক দল, রাজনীতি করেই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার অভিলাষ আছে, সেক্ষেত্রে ওয়ালিমা, খৎনা, ইফতার, ওয়াজ মাহফিল, ব্যবসা, তাদের যেকোনো আয়োজনে, যেকোনো উদ্যোগে রাজনীতি থাকবে এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। বরং চরমোনাই পীরের এই ওয়ালিমার রাজনীতি অন্যান্য দলের জন্যও একটি পলিটিক্যাল সবক হতে পারে। যেহেতু অন্য ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের এক ছাদের নিজে জড়ো করা কঠিন, সেক্ষেত্রে এ ধরনের সামাজিক আয়োজন নিজেদের জোট শক্ত করার একটি ভালো উপায় হতে পারে। মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাসদের উচিৎ তাদের ছেলেমেয়েদের ওয়ালিমা করা যায় কিনা ভেবে দেখা। নুরুল হক নুরু কখন বিয়ে করেছে আমরা কেহ জানিনা। তাই নতুন করে তার উচিৎ তার বিগত বিয়ের একটি ওয়ালিমা দেয়া। এভাবে চিন্তা করতে পারে জুনায়েদ সাকি, এবি পার্টির মঞ্জু/তাজুলেরা। সামনে তারেক রহমান তার কোনো মেয়ের বিয়ে দিলে অবশ্যই যাতে ওয়ালিমা করে এটি দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে এখনই তোলা উচিৎ। সেই আয়োজনে শেখ হাসিনাকেও দাওয়াত করা যেতে পারে।
চরমোনাই পীরের দল ১৯৯১ সালে পূর্নাঙ্গ রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সেই হিসেবে দলটির বয়স একেবারে কমও নয়। এই নাতিদীর্ঘ সময়ে তারা তাদের পীর/মুরিদির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে কর্মী তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। তাদের অতিকথন, অতি ফতোয়াবাজি, বাঘ, হরিনের ঈশপের গল্প, অদ্ভুত মুদ্রায় জিকির সহ ইত্যাদি নানা সমালোচনার মধ্যেই দলটি তাদের রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় বেশ চমক দেখাতে সক্ষম হয়েছে৷ তাদের এই সক্ষমতার বড় উদাহরণ সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনে সক্রিয় অংশগ্রহণ। বলা হয় সরকারের বি টিম হিসেবে চরমোনাই নির্বাচনে অংশ নেয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সরকার যদি তাদের স্পেস দেয়, একটি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা কেন এই সুযোগ নিবেনা? এখানে আপনি নীতি নৈতিকতার আলাপ তুলবেন? ভাই ভোটের রাজনীতিতে নীতি নৈতিকতার তেমন বালাই নাই৷ বিশেষ করে বাংলাদেশে তো নয়ই। সত্য হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে, এবং নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখতে তারা সরকারের দেয়া সুযোগ নিবে এটাই স্বাভাবিক।
বরিশাল সিটি নির্বাচনে তাদের দলের নায়েবে আমির ফয়জুল করিমের প্রার্থী হওয়া আরও একটি নতুন চমক। সম্প্রতি রংপুর সিটি নির্বাচন সহ বিভিন্ন নির্বাচনে তাদের ভোটার পার্সিন্টিজ দেখে সম্ভবত দলটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ রংপুরের নির্বাচনে হাতপাখার প্রার্থী দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলো। বিশ্লেষকদের ধারণা মোট ভোটের অন্তত ৬ থেকে ৭% এই মুহূর্তে চরমোনাইয়ের দলটির দখলে আছে। এছাড়া বরিশাল হচ্ছে দলটির রাজনীতির আঁতুড়ঘর। সেই বরিশাল নিজেদের দখলে নিতে পারলে চরমোনাই দল হিসেবে দারুণ উপকৃত হওয়ার সুযোগ আছে৷ অনেকেই বলছেন, অর্ডার অব প্রেসিডেন্সিতে বরিশালের মেয়রের তো তেমন মর্যাদা নাই। নাই মন্ত্রী মর্যাদা, নাই হাফ মন্ত্রী, কোয়ার্টার মন্ত্রীর সমান মর্যাদাও! তবুও কেন দলের স্বয়ং নায়েবে আমির ( সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আমির) কে মেয়দ পদে দাঁড় করিয়ে দিলো দলটি?
দেখুন ফয়জুল করিম নিজে কোনদিন সাংসদ/মন্ত্রী ছিলেন না৷ ছিলেন না উপজেলা চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো বড় পদে৷ এছাড় এখন পর্যন্ত দলটির নেই কোনো সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান। সিটি মেয়র তাই তাদের জন্য একটি বড় পদ। নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে এই সুযোগটি তারা নিতেই হতো। আপাতত মেয়র হওয়াটাই তাদের বড় রাজনৈতিক অর্জন হতে পারে। বড় অর্জনের জন্য বড় প্রার্থীকেই তারা বেছে নিয়েছে। আমি মনে করছি দলটির পক্ষ থেকে এটি একটি ‘ওয়াইজ ডিসিশান’। যদি ফয়জুল করিম এ দফা মেয়র হয়ে যান তাহলে সারা বাংলাদেশে দলটির ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নেতাকর্মীরা কাজ করার ব্যাপারে আরও উদ্দীপনা পাবে। হেরে গেলেও অসুবিধা নাই, বিতর্কিত করা যাবে বর্তমান ইলেকশন কমিশনকে।
এবার আসি চরমোনাই পীরদের জামায়াত বিরোধিতা নিয়ে। চরমোনাই পীর মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামিলীগ বিএনপিকে যতটানা প্রতিপক্ষ মনে করে তার চাইতে বেশি প্রতিপক্ষ মনে করে জামায়াতে ইসলামীকে। এর কারন ধর্ম ভিত্তিক দল হিসেবে জামায়াত যত দূর্বল হবে চরমোনাই তত শক্তিশালী হবে। তাই আমরা দলটির একেবারে শীর্ষ থেকে নিম্ন, সকল স্তরের নেতাকর্মীদের জামাতের বিরোধিতা করতে দেখি। বিশেষ করে সরকারের নানামুখী চাপে জামায়াত যখন একেবারে রুগ্ন, জীর্ণশীর্ণ , সেই সুযোগে মাঠ দখলের চেষ্টায় আছে চরমোনাই। চরমোনাইয়ের জন্য এই ‘জামায়াত বিরোধীতার’ নীতি ফলদায়কও হচ্ছে বলা যায়। আমার ধারণা দিন যত যাবে চরমোনাই তত জামায়াতের আরও শক্ত বিরোধী হয়ে উঠবে। দলটির এখন ভাবনাই সম্ভবত জামায়াত কে মাঠ থেকে আউট করে ধর্মীয় রাজনীতির মাঠটি নিজেদের একার দখলে আনা। তাই এ ব্যাপারে জামায়াত নেতাকর্মীদের রাগ, অভিমান, ছেড়ে চরমোনাই মোকাবেলার পলিসি গ্রহণ করারই অধিক যুক্তিযুক্ত হবে।